University of Burdwan
1st Semester Minor Political Science Notes
Paper: Political Theory
১) রাজনীতি
চর্চায় সাবেকী দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আলোচনা করো।
উত্তর;
ভূমিকাঃ
রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় যতগুলি দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত আছে, সেগুলির মধ্যে অন্যতম হল সাবেকি
দৃষ্টিভঙ্গি। সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির প্রবক্তাদের মধ্যে অ্যারিস্টোটল, মেকিয়াভেলি, হবস,
লক,
রুশো,
কান্ট,
হেগেল প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির সংজ্ঞাঃ
সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি বলতে অ্যালান বল সেইসব দৃষ্টিভঙ্গিকে বুঝিয়েছেন যেগুলি
১৯০০ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব পর্যন্ত রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় বিশেষভাবে অনুসৃত হত।
যদিও তিনি সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গি বলতে রাজনৈতিক আলোচনার জগতে অপ্রচলিত বা বাতিল হয়ে
যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গিগুলিকে বোঝাননি। এই দৃষ্টিভঙ্গি মূলত আদর্শ স্থাপনকারী, মূল্যবোধাত্মক, দার্শনিক, ঐতিহাসিক, আইনগত প্রভৃতি
পদ্ধতিতে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিষয়বস্তু আলোচনা করে।
প্রকৃতি বা বৈশিষ্ট্যঃ
উপরিউক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির নিম্নলিখিত প্রকৃতি বা
বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা যেতে পারে। যেমন-
i) মূল্যবোধাত্মক ধারণা:
সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গীতে রাষ্ট্রকে কেবল একটি প্রশাসনিক কাঠামো নয়, বরং একটি নৈতিক
প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখা হয়। এখানে ন্যায়, নৈতিকতা, স্বাধীনতা, সাম্য ও
কল্যাণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়। প্লেটো, অ্যারিস্টটল ও হেগেলের চিন্তায়
রাষ্ট্র মানুষের নৈতিক উন্নয়নের মাধ্যম। এই দৃষ্টিভঙ্গী মনে করে রাষ্ট্রের প্রধান
লক্ষ্য হলো ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন ও নাগরিকদের নৈতিক উৎকর্ষ সাধন।
ii) ঐতিহাসিক ও দার্শনিক পদ্ধতির অনুসরণ:
সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিশ্লেষণে ইতিহাস
ও দর্শনের গুরুত্বকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়। রাষ্ট্রকে একটি বিকাশমান প্রতিষ্ঠান
হিসেবে দেখা হয়,
যা দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠেছে। প্লেটো, ম্যাকিয়াভেলি, হবস ও লকের
রাজনৈতিক চিন্তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে রাষ্ট্রের উৎপত্তি, রূপান্তর ও
শাসনব্যবস্থার বিবর্তন ব্যাখ্যা করা হয়।
iii) প্রতিষ্ঠানকেন্দ্রীক আলোচনা:
এই দৃষ্টিভঙ্গীতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যেমন সরকার, সংসদ, বিচার বিভাগ ও
রাজনৈতিক দলকে আলোচনার মূল কেন্দ্র হিসেবে ধরা হয়। এসব প্রতিষ্ঠানের গঠন, ক্ষমতা ও
কার্যপ্রণালী বিশ্লেষণের মাধ্যমে শাসনব্যবস্থার কার্যকারিতা বোঝার চেষ্টা করা হয়।
রাষ্ট্র কীভাবে নাগরিক জীবনে প্রভাব ফেলে এবং প্রশাসনিক কাঠামো কীভাবে কাজ করে—তা
ব্যাখ্যা করাই এর প্রধান লক্ষ্য।
iv) রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্বতন্ত্র সংরক্ষণ:
সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গী রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে একটি স্বতন্ত্র ও স্বাধীন শাস্ত্র হিসেবে
প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এটি সমাজবিজ্ঞান, অর্থনীতি বা মনোবিজ্ঞানের সঙ্গে
অতিরিক্ত সংমিশ্রণকে এড়িয়ে চলে। রাষ্ট্র, ক্ষমতা ও শাসনব্যবস্থাকে কেন্দ্র
করে গবেষণার মাধ্যমে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের নিজস্ব ক্ষেত্র ও গুরুত্ব নির্ধারণ করা হয়
এবং একে পৃথক একাডেমিক শাস্ত্র হিসেবে তুলে ধরা হয়।
v) বাস্তব উপযোগীতাকেন্দ্রীক দৃষ্টিভঙ্গি:
এই দৃষ্টিভঙ্গী রাষ্ট্র পরিচালনার বাস্তব সমস্যা ও
তার সমাধানের ওপর জোর দেয়। আইন প্রয়োগ, শাসনের কার্যকারিতা, ন্যায়বিচার
প্রতিষ্ঠা ও জনকল্যাণমূলক নীতির বাস্তব প্রয়োগ এখানে গুরুত্বপূর্ণ। রাষ্ট্র
কীভাবে কার্যকরভাবে সমাজ পরিচালনা করতে পারে এবং জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করতে
পারে—তা বাস্তবভিত্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে নির্ধারণ করাই এর মূল উদ্দেশ্য।
সমালোচনাঃ
রাষ্ট্রচিন্তার ইতিহাসে সাবেকী দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করলেও
এর সমালোচনাও কোনো অংশে কম নেই। নীচে সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্বপূর্ণ
সমালোচনাগুলি উল্লেখ করা হল-
i) মূল্যবোধের প্রাধান্য:
সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গী অতিমাত্রায় নৈতিক ও আদর্শগত মূল্যবোধের উপর নির্ভরশীল
হওয়ায় বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে ব্যর্থ হয়।
রাষ্ট্রকে নৈতিক আদর্শের প্রতীক হিসেবে দেখা হলেও বাস্তবে রাষ্ট্রের কার্যক্রম
প্রায়ই ক্ষমতা, স্বার্থ ও বাস্তব সীমাবদ্ধতার দ্বারা পরিচালিত হয়। ফলে এই দৃষ্টিভঙ্গী বাস্তব
রাজনৈতিক সমস্যার যথার্থ বিশ্লেষণ দিতে পারে না।
ii) অনুমানভিত্তিক ও কল্পনাশ্রয়ী:
সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গী অনেক ক্ষেত্রে কল্পনাপ্রসূত ও তাত্ত্বিক চিন্তার উপর
দাঁড়িয়ে আছে। প্লেটো বা অ্যারিস্টটলের আদর্শ রাষ্ট্র ধারণা বাস্তব জীবনের জটিলতা
ও দ্বন্দ্বকে পুরোপুরি বিবেচনায় আনে না। এসব চিন্তায় একটি নিখুঁত রাষ্ট্রের
কল্পনা করা হলেও বাস্তব রাষ্ট্রে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, স্বার্থসংঘাত ও সামাজিক বৈচিত্র্য
বিদ্যমান থাকে, যা এই তত্ত্বে উপেক্ষিত।
iii) ব্যক্তি বা গোষ্ঠির ভূমিকা অস্বীকার:
সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গীতে রাষ্ট্র ও তার প্রতিষ্ঠানকে
অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়ায় ব্যক্তি ও সামাজিক গোষ্ঠীর ভূমিকা উপেক্ষিত হয়।
ব্যক্তিস্বাধীনতা,
মতপ্রকাশ এবং বিভিন্ন শ্রেণি বা গোষ্ঠীর প্রভাব যথাযথভাবে আলোচিত হয় না। ফলে
রাষ্ট্রকে একটি যান্ত্রিক কাঠামো হিসেবে দেখা হয়, যেখানে মানুষের ভূমিকা গৌণ হয়ে
পড়ে, যা আধুনিক গণতান্ত্রিক চিন্তার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
iv) আন্তঃসামাজিক বিজ্ঞানের সহযোগিতা অস্বীকার:
এই দৃষ্টিভঙ্গী রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে অন্যান্য সামাজিক
বিজ্ঞান থেকে আলাদা রাখতে চায়, ফলে সমাজবিজ্ঞান,
অর্থনীতি বা মনোবিজ্ঞানের অবদানকে গুরুত্ব দেয় না। কিন্তু আধুনিক সমাজে
রাষ্ট্রের কার্যক্রম বোঝার জন্য এসব শাস্ত্রের সহায়তা অপরিহার্য। এই সহযোগিতার
অভাবে সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গী রাষ্ট্রের বাস্তব আচরণ ও সামাজিক প্রভাব বিশ্লেষণে
সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে।
v) বাস্তব উপযোগিতা নিয়ে সংশয়:
সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গীর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বাস্তবে
প্রয়োগ করা অনেক ক্ষেত্রে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। আদর্শ রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থার
ধারণা বাস্তব সমাজে কার্যকর প্রমাণিত হয়নি। প্লেটো বা অ্যারিস্টটলের চিন্তা
বাস্তব রাষ্ট্র পরিচালনায় সীমিত সাফল্য দেখিয়েছে। ফলে এই দৃষ্টিভঙ্গীর ব্যবহারিক
মূল্য ও কার্যকারিতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ দেখা যায়।
উপসংহার;
পরিশেষে বলা যায়, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের সাবেকি দৃষ্টিভঙ্গী রাষ্ট্রের আদর্শ
এবং নৈতিকতার ওপর ভিত্তি করে একটি শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে তুলেছে, যা আধুনিক রাষ্ট্রচর্চার ক্ষেত্রে আজও প্রাসঙ্গিক। এই দৃষ্টিভঙ্গীর মাধ্যমে
রাজনীতি,
শাসনব্যবস্থা, এবং রাষ্ট্রের বিভিন্ন দিকের মৌলিক আলোচনার সূত্রপাত হয়েছে, যা পরে বিভিন্ন চিন্তাবিদ দ্বারা পরিমার্জিত এবং সমৃদ্ধ হয়েছে।

0 মন্তব্যসমূহ