সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্ব | সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও সমালোচনা | Political Science Notes

Ad Code

সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্ব | সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও সমালোচনা | Political Science Notes

 

University of Burdwan

1st Semester Minor Political Science Notes

Paper: Political Theory

সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্ব কী? এর সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য, সমালোচনা ও গুরুত্ব সহজ বাংলায় আলোচনা করা হয়েছে। BA Political Science পরীক্ষার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নোটস।, সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্ব, Pluralistic Theory of Sovereignty, Political Science Bengali Notes, বহুত্ববাদী তত্ত্ব, সার্বভৌমিকতার ধারণা, Political Science Notes in Bengali, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সার্বভৌমিকতা, সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্ব আলোচনা, বহুত্ববাদী তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য ও সমালোচনা, BA Political Science Sovereignty Notes, সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্ব কী?, বহুত্ববাদী তত্ত্বের প্রবক্তা কারা?, বহুত্ববাদী তত্ত্বের দুটি বৈশিষ্ট্য লেখো।, বহুত্ববাদী তত্ত্বের প্রধান সমালোচনা কী?, 



২) সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বটি আলোচনা করো
উত্তর;

ভূমিকা;

রাষ্ট্রবিজ্ঞানে সার্বভৌমিকতা একটি মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। প্রচলিত বা এককতাবাদী (Monistic) তত্ত্বে সার্বভৌমিকতাকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ, অবিভাজ্য ও চূড়ান্ত ক্ষমতা হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জটিলতা, সামাজিক সংগঠনের বিস্তার এবং ব্যক্তির অধিকারের বিকাশ এই ধারণাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে। এই প্রেক্ষাপটে সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে।


সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বের সংজ্ঞা:

সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্র সমাজের একমাত্র ও সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী নয়। এই তত্ত্ব মনে করে যে সমাজে রাষ্ট্রের পাশাপাশি আরও বহু সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান, যেমন—পরিবার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শ্রমিক সংগঠন, পেশাগত সংঘ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি, যেগুলো নিজ নিজ ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র কর্তৃত্ব ভোগ করে। ব্যক্তি কেবল রাষ্ট্রের সদস্য নয়; সে একাধিক সামাজিক গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং তাদের প্রতিও আনুগত্য প্রকাশ করে। ফলে সার্বভৌমিকতা কোনো একক কেন্দ্রে সীমাবদ্ধ না থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বণ্টিত থাকে। এই মতবাদ রাষ্ট্রকে অন্যান্য সামাজিক সংগঠনের ঊর্ধ্বে না রেখে তাদের সমপর্যায়ে স্থাপন করে। হ্যারল্ড ল্যাস্কি, গার্নার ও কোলের মতো চিন্তাবিদরা এই তত্ত্বের প্রবক্তা, যারা রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার ধারণাকে অস্বীকার করে বহুমাত্রিক ক্ষমতার ধারণা উপস্থাপন করেছেন।


সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্য;

সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্ব রাষ্ট্রকে একমাত্র ও সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে না দেখে সমাজের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে ক্ষমতার বণ্টনকে স্বীকৃতি দেয়। সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বের মূল বৈশিষ্ট্যগুলি নীচে উল্লেখ করা হল-


i) সার্বভৌমিকতার বিভাজনযোগ্যতা: বহুত্ববাদী তত্ত্ব অনুযায়ী সার্বভৌমিকতা কোনো একক কর্তৃত্বের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের মধ্যে বিভক্ত থাকে। রাষ্ট্র ছাড়াও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, শ্রমিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও সামাজিক গোষ্ঠী নিজ নিজ ক্ষেত্রে কর্তৃত্ব প্রয়োগ করে। ফলে সার্বভৌমিকতা অবিভাজ্য নয়, বরং বাস্তব পরিস্থিতিতে বহুমুখী ও বণ্টিত রূপ ধারণ করে।

ii) রাষ্ট্র সর্বময় নয়: 

    এই তত্ত্ব রাষ্ট্রকে সর্বশক্তিমান বা চূড়ান্ত কর্তৃত্বের অধিকারী বলে স্বীকার করে না। রাষ্ট্র সমাজের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতোই একটি সংগঠন মাত্র। ব্যক্তি শুধু রাষ্ট্রের প্রতি নয়, বরং বিভিন্ন সামাজিক ও অর্থনৈতিক সংগঠনের প্রতিও আনুগত্য প্রকাশ করে। এর ফলে রাষ্ট্রের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ হয় এবং একক কর্তৃত্বের ধারণা দুর্বল হয়ে পড়ে


iii) ব্যক্তিস্বাধীনতার গুরুত্ব: 

    বহুত্ববাদী তত্ত্বে ব্যক্তিস্বাধীনতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। যেহেতু ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে কেন্দ্রীভূত নয়, তাই ব্যক্তি বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে নিজের মত প্রকাশ ও অধিকার রক্ষা করতে পারে। রাষ্ট্রের স্বেচ্ছাচারিতা কমে এবং নাগরিকের স্বাধীন চিন্তা ও কর্মকাণ্ড বিকশিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়


iv) গোষ্ঠী ও সংগঠনের ভূমিকা: 

    এই তত্ত্ব মতে সমাজ মূলত বিভিন্ন গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে গঠিত। শ্রমিক ইউনিয়ন, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, ব্যবসায়ী সংগঠন ও রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্র এসব গোষ্ঠীর মধ্যে সমন্বয় সাধন করে এবং তাদের স্বার্থের ভারসাম্য রক্ষা করে সমাজ পরিচালনা করে


v) গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন: 

    বহুত্ববাদী তত্ত্ব গণতন্ত্রের মৌলিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংগঠন গঠনের অধিকার এই তত্ত্বে বিশেষভাবে গুরুত্ব পায়। এতে রাষ্ট্রের একনায়কতান্ত্রিক প্রবণতা হ্রাস পায় এবং জনগণের অংশগ্রহণমূলক শাসনব্যবস্থা গড়ে ওঠে


সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্বের সমালোচনা;

সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্ব বিভিন্ন দিক থেকে সমালোচিত হয়েছে। এরমধ্যে গুরুত্বপূর্ন কিছু সমালোচনা নীচে উল্লেখ করা হল-


i) রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব দুর্বল হয়ে পড়ে: 

    বহুত্ববাদী তত্ত্বে রাষ্ট্রকে অন্যান্য সংগঠনের সমপর্যায়ে স্থাপন করায় তার সর্বোচ্চ কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ণ হয়। এর ফলে আইন প্রয়োগ, শৃঙ্খলা রক্ষা ও জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে রাষ্ট্র দুর্বল হয়ে পড়ে। শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থা ছাড়া সমাজে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন হয়, যা এই তত্ত্ব যথাযথভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে না।


ii) বিশৃঙ্খলা ও সংঘাতের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়: 

    বহুত্ববাদী তত্ত্বে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের সমান ক্ষমতার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এতে স্বার্থের সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। যখন প্রতিটি গোষ্ঠী নিজ নিজ দাবি নিয়ে অগ্রসর হয়, তখন রাষ্ট্রের পক্ষে সমন্বয় রক্ষা করা কঠিন হয়। ফলে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা বৃদ্ধি পায়


iii) সার্বভৌমিকতার ধারণা অস্পষ্ট হয়ে যায়: 

    এই তত্ত্বে সার্বভৌমিকতার কোনো সুস্পষ্ট সংজ্ঞা পাওয়া যায় না। ক্ষমতা যদি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বিভক্ত থাকে, তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার কার হাতে—তা নির্ধারণ করা কঠিন হয়। এতে সার্বভৌমিকতার মৌলিক বৈশিষ্ট্য যেমন সর্বোচ্চতা ও চূড়ান্ততা দুর্বল হয়ে পড়ে, যা রাষ্ট্রচিন্তায় বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে


iv) জাতীয় সংকটে অকার্যকর প্রমাণিত হয়: 

    যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা জাতীয় জরুরি অবস্থার মতো সংকটকালে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অপরিহার্য। কিন্তু বহুত্ববাদী কাঠামোতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ বিলম্বিত হয়, কারণ বিভিন্ন গোষ্ঠীর মতামত সমন্বয় করতে হয়। ফলে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়, যা জাতীয় নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে


v) বাস্তব প্রয়োগের সীমাবদ্ধতা রয়েছে: 

    বহুত্ববাদী তত্ত্ব তাত্ত্বিকভাবে আকর্ষণীয় হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ সীমিত। অধিকাংশ আধুনিক রাষ্ট্রেই শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রই সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে কাজ করে। বিভিন্ন সংগঠন থাকলেও তারা রাষ্ট্রের আইন ও কর্তৃত্বের অধীনেই পরিচালিত হয়। ফলে বাস্তব রাষ্ট্রব্যবস্থায় এই তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে কার্যকর হয় না


উপসংহার;

পরিশেষে বলা যায়, সার্বভৌমিকতার বহুত্ববাদী তত্ত্ব আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রগতিশীল সংযোজন। এটি রাষ্ট্রের একক ও স্বৈর ক্ষমতার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করে ব্যক্তি ও সামাজিক গোষ্ঠীর গুরুত্ব তুলে ধরেছে। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও বিকেন্দ্রীকরণের ধারণাকে শক্তিশালী করতে এই তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ

Ad Code